মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম:
আল্লাহ তাআলা চান মুমিন যেন পাপমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করে। আর এ পরিচ্ছন্ন অবস্থায়ই যেন তার মৃত্যু হয়। এ জন্য পাপ ও ঋণমুক্ত থাকা অপরিহার্য।
মৃত ব্যক্তির হক মৃত ব্যক্তির হক চারটি।
কাফন-দাফন : একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পর ওয়ারিশদের প্রথম কর্তব্য হলো, তার ত্যাজ্য সম্পদ থেকে মধ্যম মানের ব্যয়ে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা।
ঋণ পরিশোধ করা : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা।
অসিয়ত পূরণ করা : সে কোনো অসিয়ত করে গিয়ে থাকলে এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দিয়ে অসিয়ত পূরণ করা।
বণ্টন করা : অবশিষ্ট সম্পদ তার ওয়ারিশদের মধ্যে কোরআন, সুন্নাহ ও ইজমা অনুযায়ী বণ্টন করা।
ঋণ পরিশোধ না করার পরিণতি : ঋণের গুনাহ মারাত্মক। তা বান্দার হক তাই ঋণদাতা তাকে ক্ষমা না করলে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মুমিনের আত্মা তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে, অর্থাৎ জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ তার ঋণ পরিশোধ করা না হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ১০৭৮ মুসনাদ আহমদ, মিশকাত পৃষ্ঠা. ১৬৪)
মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ (রা.) বলেন, আমরা মসজিদ-ই-নববীর সম্মুখে যেখানে জানাজা রাখা হতো, সেখানে বসা ছিলাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)ও আমাদের মাঝে উপবিষ্ট ছিলেন। আমরা দেখলাম, তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তারপর দৃষ্টি অবনমিত করে কপালে হাত রেখে বলেন, সুবহানাল্লাহ! কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হলো! বর্ণনাকারী বলেন, আমরা এক দিন ও এক রাত চুপ থাকলাম। এ সময়ের মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছুই দেখলাম না। হাদিস বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বলেন, (দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর) আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হয়েছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ঋণ সম্পর্কীয় কঠিন বিধান। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তারপর পুনর্জীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তারপর পুনর্জীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয় তথা তিনবার শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে, আর তার অনাদায়ী ঋণ থেকে যায়, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ তার ঋণ পরিশোধ না করা হয়। (আবু দাউদ, মিশকাত পৃষ্ঠা. ১৬৩)
মহানবী (সা.) জানাজায় যে প্রশ্ন করতেন
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, শহীদের সব গুনাহই ক্ষমা করে দেওয়া হবে। মাফ হবে না শুধু ঋণ। (মুসলিম)
মহানবী (সা.) কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনলে তার জানাজায় উপস্থিত হতেন। তিনি বলেছেন, জানাজায় উপস্থিত হয়ে তিনি প্রশ্ন করতেন এ ব্যক্তির কোনো ঋণ আছে কি না? যদি প্রত্যুত্তরে বলা হতো আছে, তাহলে তিনি বলতেন তার ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য আছে কি? যদি বলা হতো আছে, তাহলো ওয়ারিশদের বলতেন তা পরিশোধ করে দাও। অতঃপর জানাজা পড়াতেন। আর যদি বলা হতো পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই, তখন তিনি বলতেন, এ ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার, আমি নবী ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল হিসেবে তা প্রদান করব। (শরহে সুন্নাহ)
ঋণ পরিশোধ করার বাসনা : ঋণ পরিশোধ করার নিয়ত থাকলে আল্লাহ তাআলা সাহায্য করেন। মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এবং তা আদায় করার নিয়ত রাখে। আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করে দেন, অর্থাৎ পরিশোধ করা সহজ করে দেন। আর যে ব্যক্তি ঋণ নিয়ে তা আদায় করার নিয়ত রাখে না, আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করেন (সহিহ বুখারি)।
ঋণ পরিশোধ করার অনিচ্ছা : ঋণ পরিশোধে উদাসীন হওয়া হারাম। যত দ্রুত পারা যায় ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া উত্তম। কারণ জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। মহানবী (সা.) বলেন, সক্ষম ব্যক্তির ঋণ আদায়ে গড়িমসি করা তার মানহানী ও শাস্তিকে বৈধ করে দেয়। (আবু দাউদ)
শিক্ষা : পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত ঋণের ভয়াবহতা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, যাতে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কবরে যেতে না হয়। মৃত্যুর পর ওয়ারিশরা সম্পদ বণ্টন করে নিয়ে যাবে। তারা ঋণ পরিশোধ না করলে ঋণের শাস্তি পেতেই হবে। বিশেষ করে ব্যাংক, ব্যক্তি বা এনজিও ইত্যাদি থেকে সুদে ঋণ গ্রহণ করার ব্যাপারে অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করা উচিত। কারণ সুদের নিম্নতম গুনাহ হলো নিজ মাকে বিবাহ করা। আর সর্বোচ্চ গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।