নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে দুর্নীতি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দেওয়া ২৫ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্যসচিব (স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এদিকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তিন চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ এম এম শরীফুল আলম, অধ্যাপক ডা. ওবায়দুল্লাহ বাকী ও অধ্যাপক ডা. মানস কুমার বসুর কাছ থেকে প্রতীকী ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লাখ টাকা করে আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ মঙ্গলবার এক রায়ে এ নির্দেশ দেন।
এ রায়ের সময় উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার মনোজ কুমার ভৌমিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার ও সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। অপরপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোশফিক উদ্দিন বখতিয়ার ও কাজী ইরশাদুল আলম।
রায়ে বলা হয়েছে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য কেনা আটটি অত্যাধুনিক আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটরি ভেন্টিলেটর (এআরভি) মেশিন স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারে অবহেলার ঘটনায় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. এ এম এম শরীফুল আলম, অধ্যাপক ডা. ওবায়দুল্লাহ বাকী ও অধ্যাপক ডা. মানস কুমার বসুর কাছ থেকে প্রতিকী ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লাখ টাকা করে আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই টাকা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের উন্নয়ন তহবিলে জমা দিতে বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ প্রদানে ব্যর্থ হলে পাবলিক ডিমান্ড রিকোভারি অ্যাক্ট (পিডিআর)-২০১৩ অনুযায়ী ওই টাকা আদায় করতে হবে।
আর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মোয়াররফ হোসেন মেশিন সচল করার জন্য ২০১৪ ও ১৫ সালে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন-এই দাবির বিষয়ে তদন্ত করতে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। এরপর ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। তদন্তে মোয়াররফ হোসেনের দাবি সঠিক না হলে তার কাছ থেকেও প্রতিকী ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লাখ টাকা আদায় করতে বলা হয়েছে। আর যদি তার দাবি সঠিক হয় তবে ন্যাশনাল ইলেক্ট্রো মেডিকেল ইক্যুপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়াকশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাইয়ুম (যুগ্ম সচিব, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) এবং মো. রেজানুর রহমান (যুগ্ম সচিব) এর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে আদায় করতে হবে। তবে মোয়াররফ হোসেনের অবসরকালীন সুবিধা স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছে।
আদালত বলেছেন, দেশের একমাত্র ক্যান্সার রিচার্স ইন্সটিটিউট এবং হাসপাতালে এই চরম অব্যবস্থাপনা, দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কর্তব্যে অবহেলা শুধুমাত্র দুঃখজনকই নয়, তা নিন্দনীয় ও উদ্বেগের বিষয়।
ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট (এনআইসিআরএইচ) ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য উচ্চমাত্রাসম্পন্ন কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা, স্থাপন ও ব্যবহারে অনিয়ম বিষয়ে সংবাপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘অবহেলায় পড়ে আছে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের অত্যাধুনিক আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটরি ভেন্টিলেটরি’ শিরোনামে একটি ইংরেজি দৈনিকে গত ২ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোজ কুমার ভৌমিক ও এম এমদাদুল হক। এরপর আদালত ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সেদিনই স্বপ্রনোদিত হয়ে অন্তবর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করেন। আদেশে উচ্চমাত্রা সম্পন্ন কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা, স্থাপন ও ব্যবহারে অনিয়ম তদন্ত করতে বলা হয়।
সম্প্রতি অবসরে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মোয়াররফ হোসেনের অবসরকালীন (পেনশন) সুবিধা স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই আদেশের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব(হাসপাতাল) মো. সিরাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রতিবেদন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রুলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট রায় দিলেন।স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে দুর্নীতির ১১টি খাত
এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে তা রোধে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ২৫ দফা সুপারিশ পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। প্রতিবেদনে দুর্নীতির উৎস হিসেবে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসা দেওয়া, চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইকুপমেন্ট ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ বিভিন্ন খাত চিহ্নিত করা হয়। এসব উৎস বন্ধে দুদকের করা সুপারিশে বলা হয়, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে ইজিপি টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপন ও অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্থায়ী চিকিৎসক বা কর্মচারী ও কার্যনির্বাহী কমিটি ইত্যাদি রয়েছে কি-না এসব বিষয় নিশ্চিত হওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির নীতিমালা প্রণয়ন, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা; ইন্টার্নশিপ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করা এবং বর্ধিত এক বছর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে থাকা বাধ্যতামূলক করা, চিকিৎসকদের (সরকারি/বেসরকারি) পদোন্নতির জন্য সরকারি ক্ষেত্রে পিএসসি এবং বেসরকারিদের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য) ও পিএসসির প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মতামত গ্রহণ, তথ্য বহুল সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন, মালামাল রিসিভ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সংস্থার সদস্যদের অন্তর্ভূক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
[সূত্র-কালের কন্ঠ]