এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া:
“শত্রু-মিত্র মিলমিশ,সব সাপের একই বিষ !ভিন্ন ভিন্ন নাম, একই কাম !ক্ষমতায় যা্ও, লুটেপুটে খাও !”
দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের মতামত হলো, ‘দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার।’ ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশানালের মত হলো, ‘সরকারি দফতরকে ব্যক্তি স্বার্থে কাজে লাগানো, যেখানে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।’ আসলে দুর্নীতি কেবল সরকারি কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত নয়, বরং সরকারি, বেসরকারি, এনজিও বিভিন্ন পেশা, শ্রেণী, পরিবার, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থেও হতে পারে। দুর্নীতি হলো প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, আইন-কানুন এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে উদ্ভুত এমন এক পরিস্থিতি যা সঠিকভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত করে। অন্য কথায় দায়িত্বে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অবৈধ স্বার্থ হাসিল করাকে দুর্নীতি বলে।
যাক, এই বিষয়ে বেশী বললে আবার পাঠক বিরক্ত হতে পারেন। সভ্যতার প্রথম থেকেই প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রচলন কমবেশি বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত প্রশাসনের উৎপত্তির সাথে সাথেই এর প্রচলন ও বিস্তার ঘটতে থাকে। এটি মানুষের স্বভাবের একটি মন্দ দিক। কিন্তু, এখন সেই মন্দ দিকটা ভয়াবহ ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে আমাদের বাংলাদেশে। দুর্নীতি মানবজাতির জন্য একটি ক্যান্সার। ক্যান্সার যেমন মানব দেহের সকল কিছুকে ধ্বংস করে দেয়, ঠিক তেমনি দুর্নীতিও একটি জাতির সকল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। চরিত্র হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মানুষের যখন চারিত্রিক গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সে শুধু অপকর্ম করতে থাকে। দুর্নীতিই হয়ে ওঠে চরিত্রহীন মানুষের প্রধান কাজ।
বাংলাদেশের মানুষ এখন এমন এক অবস্থায় আছে যেখানে প্রাথমিক স্কুলের সামান্য দফতরির চাকরি নিতেও দিতে লেন-দেন হয় লাখ টাকা। দুর্নীতির মূল কারণ হচ্ছে মানুষের লোভ। এই লোভ হতে পারে ক্ষমতার জন্য, অর্থ বা অন্য কিছুর জন্য। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, লোভ একটি মানুষকে পশুতে পরিণত করে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন করে তোলে। সে সততা, ব্যক্তিত্ব ও ভালো-মন্দ বোধ হারিয়ে ফেলে। দুর্নীতি করার জন্য তার মনের ভেতর যে প্রবৃত্তি কাজ করে তা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনও তাকে সঠিক পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়।
আমাদের সমাজে দুর্নীতি কোথায় নেই এই প্রশ্নের উত্তর খুজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি আজ ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে। প্রায়ই পত্রিকায় বিভিন্ন জায়গায় দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হয়। আমাদের অবস্থা এমন যে, মন্ত্রী অপারগ হয়ে বলেছিলেন- ঘুষ কমিয়ে খেতে; আমরা সেটা নিয়ে কৌতুক বানিয়েছি? ব্যাংক তৈকে ৪হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেলেও আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেন, এটা কোন টাকাই নয়! দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে সেটিকে ‘দিনে-দুপুরে ডাকাতি’ বলে বর্ণনা করতে বাধ্য হয়েছেন সরকারের কৃষিমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক।
পাবনার রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিভিন্ন ভবনের জন্য বিছানা, বালিশ ও আসবাবপত্র কেনায় দুর্নীতি, ফরিদপুরে হাসপাতালে পরদা কিনার দুর্নীতি, করোনাকালে মাস্ক দুর্নীতি, কিট দুর্নীতি, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকের হাজার কোটি টাকা পাচার, স্কুলের কোমলমতি শিশুদের বিদেশী মানের খিচুরি খাওয়ানোর চিন্তা নিয়ে বিদেশে প্রশিক্ষনের প্রস্তাব করা, হাতধোয়া প্রশিক্ষনের নামে শতকোটি টাকার প্রকল্প গ্রহন, মশা মারা বা পুকুর কাটা শিখতে বিদেশ সফর এগুলো আসলে কি ? ছাগল চরানো, গরুর প্রজনন, লিফট দেখার মতো শিক্ষা-অভিজ্ঞতা প্রকল্প নেয়ার দু:সাহস হয় কি করে তাদের ? দুর্নীতির মাত্রা এমন পর্যায়ে যে, মাত্র ১০ হাজার টাকায় একটি বটি বা একটি ড্রাম কেনার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করেছে। ৯ কোটি টাকার মধ্যে ৮ কোটি টাকাই লোপাট কি করে করতে হয় তার অভিজ্ঞতাও রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের। স্বস্থ্যমন্ত্রনালয়ের ডিজির ড্রাইভারের বাড়ী,গাড়ী আর অর্থের হিসাব দেখার পরতো আর কি বলার আছে ?
আজকের প্রেক্ষাপটে ‘হাওয়া ভবন’ নামক দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু ম্লান হয়ে গেছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে হাওয়া ভবনকে কি ছাড়িয়ে যায়নি আজকের দুর্নিতি ? গত ১০ বছরে হাওয়া ভবনের সংখ্যা এবং সাইজ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। জরিপে প্রকাশ, বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের ধনী হওয়ার সংখ্যা বিশ্বে এক নম্বরে।
মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, সেকেন্ড হোম প্রজেক্ট প্রথম চালু হয় ২০০২ সালে। প্রথমবার কোনো বাংলাদেশি সেকেন্ড হোমের জন্য আবেদন করেননি। ২০০৩ সালে প্রথমবার বাংলাদেশিরা আবেদন করেন। তখন থেকে এ পর্যন্ত মোট আবেদন করেছেন প্রায় ৮ হাজার ৩৫০ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে অনুমতি পেয়েছেন ৩৫৪৬ জন। সেকেন্ড হোম গড়ার পুরো টাকাই অবৈধ পথে অভিবাসিরা মালয়েশিয়ায় নিয়েছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। কী পরিমাণ অর্থ মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, যারা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন বাংলাদেশি টাকায় জনপ্রতি তাদের খরচ হয়েছে ১২ কোটি টাকা। এই টাকার নিচে কেউই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করতে পারেননি। ওই হিসেব অনুযায়ী যারা সেকেন্ড হোম করেছেন তারা প্রায় ৪২ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় অবৈধ পথে নিয়ে গেছেন। ভারত, কানাডা, ইউ.এস.এ সহ অন্যান্য দেশের হিসাব না-ই-বা দিলাম । কানাডার বেগম পল্লীর খবরতো সবারই জানা । বিশেষ করে কাস্টমস, আয়কর, পুলিশ, পররাষ্ট্র, অডিট এন্ড একাউন্টস, প্রকৌশলী হিসাবে যে কোন বিভাগে ও প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তারাই এর সাথে জড়িত এবং জড়িত অসৎ রাজনীতিবিদরা । এক এগারোর দুঃসহ অভিজ্ঞতার পর দুর্ণীতির টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে, ফলে দেশে জমি, প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রয়ের বাজার খুবই মন্দা যাচ্ছে ।
বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের এতটাই উৎসাহিত করা হয় যে দুর্নীতি করতে কেউ আগেপিছে আর ভেবে দেখে না। এরই মধ্যে দুর্নীতির শিকড় আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। মূলত দুর্নীতি সামাজিক অবক্ষয়ের গতিকে ত্বরান্বিত করে। এটি এরই মধ্যে আমাদের সামাজিক বাঁধন, নিয়মকানুন ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে ফেলেছে। একসময় দুর্নীতিগ্রস্ত বা অসৎ মানুষ খুঁজে পেতে কষ্ট হতো, এখন সৎ মানুষের খোঁজ পাওয়াই যে কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষগুলোই আমাদের প্রতিবেশী এবং ক্ষমতাধর হিসেবে সবাই তাদেরই সমীহ করে চলছে। এসব দুর্নীতিবাজ লোকের সঙ্গে বাস করা ছাড়া আমাদের কি আর কোনো উপায় নেই?
যাহোক, দুর্নীতির ইতিহাস বলে কোন লাভ নেই? তা আমরা সবাই কিছু না কিছু অবগত আছি ? প্রশ্ন হলো দুর্নীতি নাম এই ক্যান্সার থেকে মুক্তি উপায় কি ? এর উত্তর হল- সততা আর সদিচ্ছা। ক্ষমতাবান মানুষের চেয়ে সাধারণ জনগণ সংখ্যায় অনেক বেশি। তাই ক্ষমতাবানরা যদি ঠিক হয়ে যায়, তাহলে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি দেশের প্রথম সারির অফিসাররা ঠিক হয়ে যান, তাহলে তাদের অধীনে যারা আছে; তাদের ঠিক হতে সময় লাগবে না।
যদি প্রতিজন সংসদ সদস্য ঠিক হয়ে যান, তাহলে তার নাম ভাঙিয়ে কেউ দুর্নীতি করার সাহস করবে না। কয়েক কোটি জনতাকে সংশোধন করতে বেগ পেতে হবে না, যদি কয়েক হাজার অফিসারকে ঠিক করা যায়। আর যদি প্রভাব খাটানো বন্ধ করা হয়, তাহলে অবশ্যই ইনসাফ কায়েম হবে।
ক্যান্সার যেভাবে মানুষকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে যায়, দুর্নীতি ঠিক সেভাবেই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়? যেহেতু মরণব্যাধি ক্যান্সারের ওষুধ বের হয়েছে। এখন অনেকের ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাওয়ার খবর পাওয়া যায়? আমরাও যদি দুর্নীতি নামক ক্যান্সারের ওষুধ সঠিকভাবে প্রয়োগ করি, তবে প্রিয় জন্মভূমি থেকে দুর্নীতি উৎখাত করা সম্ভব?
আমরাও যদি ‘দুর্নীতি নামক ক্যান্সারের ওষুধ’ সঠিকভাবে ব্যবহার করি তবে প্রিয় জন্মভূমি থেকে দুর্নীতি উৎখাত করা সম্ভব। দেশ তখন এগিয়ে যাবে অনেক তাড়াতাড়ি। আসুন দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হই, দুর্নীতিকে উৎখাত করি। অতএব, আসুন বিদ্যমান দুর্নীতির সর্বনাশা ভয়াল থাবা থেকে মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য আমরা প্রত্যেকেই সৎ হই এবং অপরকে সৎ হিসেবে গড়ে তুলি। এর মাধ্যমে মানবজাতিকে সুখী এবং সমৃদ্ধ করি।
এ জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বজ্র কঠিন অঙ্গীকার। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যৎ দুর্নীতির চোরাগলিতে হারিয়ে যাবে। তাই আমাদের সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং লাখো শহীদের রক্তস্নাত আমাদের পবিত্র মাটি থেকে দুর্নীতিকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, এদেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতিবাজ নয়। দুর্নীতি তাদেরই হাতে, যাদের কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা আছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা এই ক্ষমতা যাদের হাতে আছে তারাই প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিবাজ হতে পারে। মূলত: যার যত বড় ক্ষমতা আছে, সে ততবড় দুর্নীতিবাজ।
[ মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন]