মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার:
শহীদ রাষ্ট্রপ্রতি জিয়াউর রহমান এবং আবু তাহের । মুক্তিযুদ্ধের আগুন পোড়া দুই খাঁটি সোনা। দেশপ্রেম এবং বলিষ্ঠ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে সচকিত এদেশের দুই কৃতি সন্তান । দুজনই আজ ইতিহাস । দু’জনেরই রয়েছে অসংখ্য অনুসারী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দু’জনেরই রয়েছে অত্যন্ত গৌরবজনক ভূমিকা । একথা স্বরণে রেখে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সর্ম্পকে তারা কী ভাবতেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সম্পর্কে তাদের চিন্তা – ভাবনা কেমন ছিল তার বিবরণসহ সাত নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতি দিবসের প্রেক্ষাপট রচনায় তাদের ভূমিকার কিঞ্চিৎ আভাস রয়েছে এই সাত নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতি দিবসে।
জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী । জাতীয়তাবাদের পরশমণির স্পর্শে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে সোনা ছড়িয়ে তিনি চেয়েছেন বাংলাদেশকে বিশ্ব সভায় গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে । সামাজিক শক্তি ও প্রতিষ্ঠান গুলোকে গণমূখী করে সচেতন জনগণের মাধ্যম হিসেবে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । অন্যদিকে তাহের বিশ্বাসী ছিলেন আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রে। উৎপাদনের উপাদানগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং বন্টন ব্যবস্থাকে গণমূখী করে তিনি চেয়েছিলেন সমাজবাদী কল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে জনকল্যাণ বৃদ্ধি করতে।
উদারনৈতিক গণতান্ত্রের ( Liberal Democracy -) প্রতি একজনের বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও মজবুত । অন্যজন কিন্তু উদারনৈতিক গণতান্ত্রকে ” বর্জোয়া গণতন্ত্র ” রুপে চিহ্নিত করে এবং জনকল্যাণের জন্য অর্থহীন মনে করে বিশ্বাস করতেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রের পূর্ণ বিকাশে। জেনারেল জিয়ার গতি তাই নির্ধারিত হয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তার আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকলাপের দিকে। অন্যজনের দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের
( Scientific Socialism) দিকে।
সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ও স্বরূপ সম্পর্কেও জিয়াউর রহমান ও আবু তাহেরের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সম্পুর্ণ স্বতন্ত্র।
জিয়ার নিকট রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জাতীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের অতন্দ্র প্রহরীরুপেই প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান । জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে, বিশেষ করে সৈনিকদের মধ্যে পেশাদারিত্ব ( Professionalism ) বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিকতার আলোকে সমুজ্জ্বল করতে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষা গ্রহণকারী তাহের কিন্তু চেয়েছিলেন মাক্সীয় দর্শনের সূত্র অনুযায়ী, ‘ পুরোনো সামরিক বাহিনীকে টুকরো টুকরো করে গুড়িয়ে দিয়ে, তারপর ( নতুন সমাজের উপযোগী করে ) পুনরায় তাকে গড়ে তুলতে’ Smash the old army, dissolve it and build a new ( Kari Marx, the Eighteenth Brumaire of Lousis Bonaparte)
কর্নেল তাহের তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ( জাসদ) আন্ডারগ্রাউন্ড সশস্ত্র শাখা বিপ্লবী গণবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশব্যাপী বিপ্লবী শক্তিসমূহের বিকাশ ও বিস্তারে মনোযোগী হন ১৯৭২ সালে প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে তারই নির্দেশনে গঠিত হতে থাকে শত শত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, অনেকটা বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ায় সৈনিক সোভিয়েটের আদলে। তাহেরের জন্য এই কাজটি সহজ হয়েছিল বিভিন্ন কারণে । এক. তখন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যার নিরিখে শুধু যে ক্ষুদ্রতর ছিল তাই নয়। খন্ড – ছিন্ন ও বিভক্ত ছিল, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণকারী এবং পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত ( repatriates) কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল এক ধরনের অনতিক্রম্য দূরত্ব । দুই – সরকার কতৃক সৃষ্ট জাতীয় রক্ষীবাহিনী এবং এই বাহিনীর প্রতি সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের সীমাহীন দূর্বলতা প্রতিরক্ষা বাহিনীর নৈতিক মান( esprit de corps)ভীষণভাবে অবনত করে । তিন-কর্নেল তাহের ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেল এবং ৪৪ বিগ্রেডের কমান্ডার হিসেবে তার ছিল কৃতিত্বপূর্ণ অর্জন। এসব কারণে তার দর্শনও নির্দেশনা সাধারণ সৈনিকদের নিকট হয়ে ওঠে গভীর আবেদনপূর্ণও আকর্ষনীয়। জাসদের তরুণ নেতৃত্বও ঐ সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রতিপক্ষরুপে প্রতিভাত হচ্ছিল এবং সেই আকর্ষণীয় নেতৃত্বের ফলে ১৯৭২ সালের শেষদিক থেকে সে সময়ে বিপ্লবী চেতনার বিস্তার ঘটে দ্রুত গতিতে । বিপ্লবী গণবাহিনীতে তাহেরের যোগদান জাসদের সামরিক উইংকে শক্তিশালী করে এবং জাসদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাহেরের সামরিক পরিকল্পনাকে দৃঢ়তর করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপ্রতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে কর্নেল তাহের খুশী হননি দুটো কারণে।
এক-যারা এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করে তাদের কোন মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। তার মতে,সবচেয়ে উত্তম পন্থা হতো জনগণকে প্রতারণার কারণে একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে সরিয়ে দেয়া,( সমগ্র জনতার মধ্যে আমি প্রকাশিত-তাহেরের টেস্টিমনি )।
দুই -খন্দকার মুশতাক আহমদের সরকার কোনক্রমে এর গ্রহণযোগ্য বিকল্প না। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে,তার মতে শুধু একটি পরিবর্তন এসেছিল এবং তা ছিল ” ইন্দো-সোভিয়েট কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছিটকে পড়েছিল আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী গহ্বরে”। তার নিজের কথায়”আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ সিভিলিয়ান একনায়কতন্ত্র থেকে নিমজ্জিত হয়েছিল সামরিক-ব্যুরোক্র্যাটিক একনায়কতন্ত্রের গভীর অন্ধকারে।
যখন কর্নেল তাহের শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের সংবাদ পেয়েছিলেন তখনই তিনি অভ্যুত্থানকারীদের সাথে আলোচনার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা রেডিও স্টেশনে। এতে খন্দকার মুশতাক আহমেদও তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কর্নেল তাহের তাদের জন্য কয়েকটি সুপারিশ করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চারটি।( ১)
চতুর্থ সংবিধানে সংশোধনী আইনের আশু প্রত্যাহার। ( ২) সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দান। ( ৩) বাকশাল ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার ( National Government -) গঠন, এবং ( ৪) নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
[ লেখকঃ নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আপন আলো ; বিশেষ প্রতিবেদক, শ্যামল বাংলা টিভি ; সাবেক কাউন্সিলর, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ও সদস্য ডিইউজে ]